ষষ্ঠ অধ্যায়ঃ ধ্যানযোগ বা অভ্যাসযোগ
শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা যথাযথ
(মূল সংস্কৃত শ্লোক ও অনুবাদ)
ষষ্ঠ অধ্যায়ঃ ধ্যানযোগ বা অভ্যাসযোগ
ভগবান উবাচ
অনাশ্রিতঃ কর্মফলম্ কার্যম্ করতি যঃ ॥
সঃ সন্নাসী চ যোগী চ নিরগ্নি ন চ অক্রিয়ঃ ॥১॥
অর্থ-ভগবান বললেন-যিনি অগ্নিহোত্রাদি কর্ম ত্যাগ করেছেন তিনি সন্নাসী বা যোগীনন,যিনি কোন রকম ফলের আশা না করে তার কর্তব্য কর্ম করেন তিনিই যথার্থ সন্নাসী বা যোগী।
যম্ সন্নাসম্ ইতি প্রাহুঃ যোগম্ তম্ পান্ডব ॥
ন হি অসংন্যস্ত সংকল্পঃ যোগী ভবতী কশ্চন ॥২॥
অর্থ-হে পান্ডব যাকে সন্নাস বলা যায় তাকেই যোগ বলা যায় কারন ইন্দ্রিয় সুখ ভোগের বাসনা ত্যাগ না করলে কখনো যোগী হওয়া যায় না।
আরুরুক্ষোঃ মুনেঃ যোগম কর্ম কারনম্ উচ্যতে ॥
যোগ আরুঢ়স্য তস্য এব শমঃ কারনম্ উচ্যতে ॥৩॥
অর্থ-অষ্টাংঙ্গ যোগ অনুষ্ঠানে যারা নবীন তাদের পক্ষে নিস্কাম কর্ম অনুষ্ঠান করাই উত্কৃষ্ট সাধন, আর যারা ইতিমধ্যে যোগরুঢ় হয়েছেন তাদেও পক্ষে সমস্ত কর্ম থেকে নিবৃত্তিই উত্কৃষ্ট সাধন।
যদা হি ন ইন্দ্রিয়ার্থেষু ন কর্মসু অনুসজ্জতে ॥
সর্ব সঙ্কল্প সন্নাসী যোগরুঢ় তদা উচ্যতে ॥৪॥
অর্থ-যখন যোগীর জড়সুখ ভোগের সমস্ত সংকল্প ত্যাগ করে ইন্দ্রিয় ভোগ্য বিষয়ের প্রতি আসক্ত রহিত হন তখন তারে যোগরুর বলা হয়।
আত্মনা আত্মনম্ ন আত্মনম অবসাদয়েত্ ॥
আত্মা এব হি আত্মন বন্ধু আত্মা এব রিপুঃ আত্মনঃ ॥৫॥
অর্থ-মানুষের কর্তব্য তার মনের দ্বারা নিজেকে জড় জগতের বন্ধন থেকে উদ্ধার করা,মনের দ্বারা আত্মাকে অধোপাতিত করা কখনো উচিত্ নয়।মন জীবের অবস্থা ভেদে বন্ধু ও শত্রু হয়।
বন্ধু আত্মা আত্মনঃ তস্য যেন আত্মা এব আত্মনা জিতঃ ॥
অনাত্মনঃ তু শত্রুত্বে বর্তেত আত্বৈব শত্রুবত্ ॥৬॥
অর্থ-যিনি তার মনকে জয় করেছে তার মন তার পরম বন্ধু কিন্তু যিনি তা করতে অক্ষম তার মন তার পরম শত্রু।
জিতাত্মনঃ প্রশান্তস্য পরমাত্মা সমাহিতঃ ॥
শীত উষ্ণ সুখ-দুঃখেষু তথা মান অপোমানয়ো ॥৭॥
অর্থ- জিতেন্দ্রিয় ও প্রশান্ত যোগরুঢ় ব্যক্তি পরমার্থকে উপলব্ধি করতে পেরেছেন। তিনি শীত ও উষ্ণ সুখ দুঃখ্যে এবং সন্মান অপমানে অবিচালিত থাকেন।
জ্ঞান বিজ্ঞান তৃপ্ত আত্মা কুটস্থঃ বিজিতেন্দ্রিয়ঃ ॥
যুক্ত ইতি উচ্যতে যোগী সমলোষ্ট্র অশ্ম কাঞ্চনঃ ॥৮॥
অর্থ-যে যোগী শাস্ত্রজ্ঞান ও তত্ত্ব অনুভূতিতে পরিতৃপ্ত,যিনি শীত উষ্ণ আদি দন্ধে নির্বিকার ও জিতেদ্রিয় এবং যিনি মৃতখন্ড প্রস্তর ও সুবর্ণে সর্বদর্শি তিনি যোগরুঢ় বলে কথিত হন।
সুহৃত্ মিত্র অরি উদাসীন মধ্যস্ত দ্বেষ্য বন্ধুষু ॥
সাধুষু অপি চ পাপেষু সমবুদ্ধিঃ বিশিষ্যতে ॥৯॥
অর্থ-যিনি সহৃত্ মিত্র শত্রু উদাসিন মধ্যস্ত মত্সর বন্ধু ধার্মিক ও পাপাচারি এবং সকলের প্রতি সমবুদ্ধি তিনিই শ্রেষ্ঠতা লাভ করেন।
যোগী যুঞ্জিত সততম আত্মানাম রহসি স্থিতঃ ॥
একাকী যতচিত্তাত্মা নিরাশীঃ অপরিগ্রাহঃ ॥১০॥
অর্থ-যোগরুঢ় ব্যক্তি সর্বদা একান্তে অবস্থিত হয়ে মনকে সমাধিযুক্ত করবেন।অসত্ পরিগ্রহ বর্জন করবেন এবং ফলাকাঙ্খা শূন্য হবেন।
শুচৌ দেশে প্রতিষ্ঠপ্য স্থিরম আসনম্ আত্মনঃ ॥
ন অতি উচ্ছ্রিতম্ ন অতি নীচম্ চেলাজিন কুশত্তরম ॥১১॥
অত্র একাগ্রম মনঃ কৃত্বা যতচিত্ত ইন্দ্রিয় ক্রিয়ঃ ॥
উপবিশ্য আসনে যুঞ্জাত্ যোগম আত্ম বিশুদ্ধয়ে ॥১২॥
অর্থ-যোগ আসনের নিয়ম এই যে কুশাষনের উপর মৃগচর্মের আসন তার উপরে বস্ত্রাশন রেখে অত্যন্ত উচু বা অত্যন্ত নিচু না করে সেই আসন বিশুদ্ধ ভূমিতে স্থাপন করে তাতে আসিন হবেন।সেখানে উপবিষ্ট হয়ে চিত্ত ইন্দ্রিয় ক্রিয়াকে নিয়ন্ত্রিত করে চিত্ত শুদ্ধির জন্য মনকে একাগ্র করে যোগ অভ্যাষ করবেন।
সমম্ কায়শির গ্রীবম্ ধারয়ন অচলম্ স্থির ॥
সংপ্রেক্ষ্য নাসিকাগ্রম স্বম্ দিশঃ চ অনবলোকয়ন ॥১৩॥
প্রশান্ত আত্মা বিগতভী ব্রহ্মচারিব্রতে স্থিতঃ ॥
মনঃ সংযম্য মত্ চিত্তঃ যুক্তঃ আসিত মত্ পরঃ ॥১৪॥
অর্থ-শরির মস্তক গ্রীবাকে সরল রেখে অন্যদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ না করে নাসিকার অগ্রভাগে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে প্রশান্তাত্মা, ভয়শুন্য ও ব্রহ্মচর্য ব্রতে স্থিত পুরুষ মনকে সমস্ত জড় বিষয় থেকে প্রত্যাহার করে আমাকে জীবনের চরম লক্ষ্যরুপে স্থির করে হৃদয়ে আমার ধ্যনপুর্বক যোগ অভ্যাষ করবেন।
যুঞ্জন এবম সদা আত্মনাম্ যোগী নিয়ত মানসঃ
শান্তিম্ নির্বান পরমাম্ মত্সংস্থাম্ অধিগচ্ছতি।।১৫
অর্থ-শরির মস্তক গ্রীবাকে সরল রেখে অন্যদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ না করে নাসিকার অগ্রভাগে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে প্রশান্তাত্মা, ভয়শুন্য ও ব্রহ্মচর্য ব্রতে স্থিত পুরুষ মনকে সমস্ত জড় বিষয় থেকে প্রত্যাহার করে আমাকে জীবনের চরম লক্ষ্যরুপে স্থির করে হৃদয়ে আমার ধ্যনপুর্বক যোগ অভ্যাষ করবেন।
যুঞ্জন এবম সদা আত্মনাম্ যোগী নিয়ত মানসঃ
শান্তিম্ নির্বান পরমাম্ মত্সংস্থাম্ অধিগচ্ছতি।।১৫
অর্থ-শরির মস্তক গ্রীবাকে সরল রেখে অন্যদিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ না করে নাসিকার অগ্রভাগে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে প্রশান্তাত্মা, ভয়শুন্য ও ব্রহ্মচর্য ব্রতে স্থিত পুরুষ মনকে সমস্ত জড় বিষয় থেকে প্রত্যাহার করে আমাকে জীবনের চরম লক্ষ্যরুপে স্থির করে হৃদয়ে আমার ধ্যনপুর্বক যোগ অভ্যাষ করবেন।
যুক্ত আহার বিহারস্য যুক্ত চেষ্টস্য কর্মষু ॥
যুক্ত স্বপ্নাববোধস্য যোগঃ ভবতী দুঃখহা ॥১৭॥
অর্থ-যিনি পরিমিত আহার বিহার করেন পরিমিত প্রয়াস করেন যার নিদ্রা জাগরন নিয়মিত তিনিই যোগ অভ্যাসের দ্বারা সমস্ত জড় জাগতিক দুঃখের নিবৃত্তি সাধন করতে পারেন।
যদা বিনিয়তম্ চিত্তম আত্মনি এব অবতিষ্ঠতে ॥
নিস্পৃহঃ সর্ব কামেভ্যঃ যুক্তঃ ইতি উচ্যতে তদা ॥১৮
অর্থ-যোগী যখন অনুশিলনের দ্বারা চিত্তবৃত্তির নিরোধ করেন এবংসমস্ত জড় কামনা বাসনা থেকে মুক্ত হয়ে আত্মাতে অবস্থান করে তখন তিনি যোগযুক্ত হয়েছে বলা হয়।
যথা দীপঃ নিবাতস্থঃ ন ইঙ্গতে সেপমা স্মৃতা ॥
যেগীনঃ যত চিত্তস্য যুঞ্জতঃ যোগম্ আত্মনঃ ॥১৯॥
অর্থ-বায়ু শুন্য স্থানে দীপ শিখা যেমন কম্পিত হয় না চিত্ত-বৃত্তির নিরোধ অভ্যাস কারি যোগীর চিত্তও তেমনই ভাবে অবিচালিত থাকে।
যত্র উপর মতে চিত্তম্ নিরুদ্ধম্ যোগ সেবয়া ॥
যত্র চ এব আত্মনা আত্মনম্ পশ্যন আত্মনি তুষ্যতি ॥২০॥
সুখম্ আত্মন্তিকম্ যত্ তত্ বুদ্ধি গ্রাহ্যম্ অতিন্দ্রিয়ম ॥
বেত্তি যত্র ন চ এব অয়ম্ স্থিতঃ চলতি তত্ত্বতঃ ॥২১॥
যম লব্ধা চ অপরম্ লাভম্ মন্যতে ন অধিকম ততঃ ॥
যস্মিন স্থিতঃ ন দুঃখেন গুরুনা অপি বিচাল্যতে ॥২২॥
তম্ বিদ্যাত্ দুঃখ সংযোগ বিয়োগম্ যোগ-সংজ্ঞিতম্ ॥২৩॥
অর্থ-যোগ অভ্যাসের ফলে যে অবস্থায় চিত্ত সম্পুর্ন রুপে জড় বিষয় থেকে প্রত্যহৃত হয়,সেই অবস্থাকে যোগ সমাধি বলা হয়।এই অবস্থায় শুদ্ধ অন্তকরন দ্বারা আত্মাকে উপলব্ধি করে যোগী পরম আনন্দ আস্বাদন করে। সেই আনন্দ অবস্থায় অপ্রাকৃত ইন্দ্রিয়ের দ্বারা অপ্রাকৃত সুখ অনুভব হয়। এই পরমার্থিক চেতনায় অবস্থিত বলে যেগী আর আত্মতত্ত্বজ্ঞান থেকে বিচলিত হন না,এবং তখন আর অন্য কিছূ লাভই এর থেকে অধিক বলে মনে হয় না। এই অবস্থায় স্থিত হলে চরম বিপর্যয়েও চিত্ত বিচলিত হয় না।জড় জগতের সংযোগজনিত সমস্ত দুঃখ-দুর্দশা থেকে এটিই হচ্ছে প্রকৃত মুক্তি।
সঃ নিশ্চয়েন যোক্তব্যঃ যোগঃ অনির্বিন্ন চেতসা ॥
সংকল্প প্রভবান কামান ত্যক্তা সর্বান অশেষতঃ ॥
মনসা এব ইন্দ্রিয় গ্রামম্ বিনিয়ম্য সমন্ততঃ ॥২৪॥
অর্থ-অবিচালিত অধ্যবসায় এবং বিশ্বাষ সহকারে এই যোগ অনুশিলন করা উচিত সংকল্প জাত সমস্ত কামনা সম্পুর্ন রুপে ত্যাগ করে মনের দ্বারা ইন্দ্রিয়গুলিকে সর্বদিক থেকে নিবৃত্ত করা কর্তব্য।
শনৈঃ শনৈঃ উপরমেত্ বুদ্ধ্যা ধৃতি গৃহীতয়া ॥
আত্ম-সংস্থম্ মনঃ কৃত্বা ন কিঞ্চিদপি চিন্তয়েত্ ॥২৫॥
অর্থ-ধৈর্যযুক্ত বুদ্ধি দ্বারা মনকে ধীরে ধীরে নিবৃত্ত করে এবং কিছু চিন্তা না করে সমাধিস্থ হতে হয়।
যতঃ যতঃ নিশ্চলতি মনঃ চঞ্চলম্ অস্থিরম্ ॥
ততঃ ততঃ নিয়ম্য এতত্ আত্মনি এব বশম্ নয়েত্ ॥২৬॥
অর্থ-যোগী তার চঞ্চল ও অস্থির মন যে বিষয় ধাবিত হয় সেই সেই বিষয়ে থেকে নিবৃত্ত করে আত্মাতে স্থির করবেন।
প্রশান্ত মনসম হি এনম্ যোগিনম্ সুখম্ উত্তমম্ ॥
উপৈতি শান্ত রজসম্ ব্রহ্মভূতম্ অকল্মসম্ ॥২৭॥
অর্থ-ব্রহ্মভূত অবস্থায় প্রশান্ত চিত্ত,রজ বৃত্তি রহিত এবং নিস্পাপ হয়ে যার মন আমাতে নিবিষ্ট হয়েছে তিনিই পরম সুখ প্রাপ্ত হয়।
যুঞ্জন এবম্ সদা আত্মানম্ যোগী বিগত কল্মষঃ ॥
সুখেন ব্রহ্ম সংস্পর্শম অত্যন্তম সুখম অশ্নুতে ॥২৮॥
অর্থ-এইভাবে আত্মসংযমী যোগী জড় জগতে সমস্থ কলুষ থেকে মুক্ত হয়ে ব্রহ্ম সংস্পর্শরুপ পরম সুখ আস্বাদনকরেন।
সর্ব ভূতস্থম্ আত্মানম সর্ব ভুতানি চ আত্মনি ॥
ঈক্ষতে যোগ যুক্তাত্মা সর্বত্র সমদর্শনঃ ॥২৯॥
অর্থ-প্রকৃত যোগী সর্বভূতে আমাকে দর্শন করে এবং আমাতে সব কিছু দর্শন করেন।যোগযুক্ত আত্মা সর্বত্রই আমাকেই দর্শন করেন।
যঃ মাম্ পশ্যতি সর্বত্র সর্বম্ চ ময়ি পশ্যতি ॥
তস্য অহম্ ন প্রনশ্যামি সঃ ট মে ন প্রনশ্যতি ॥৩০॥
অর্থ-যিনি সর্বত্র আমাকে দর্শন করেন এবং আমাতেই সমস্ত কিছু বস্তু দর্শন করেন আমি কখনো তার দৃষ্টির অগোচর হই না এবং তিনি ও আমার দৃষ্টির অগোচর হন না।
সর্বভূত স্থীতম্ যঃ মাম ভজতী একত্তম্ আস্থিতঃ ॥
সর্বথা বর্ত্তমানঃ অপি সঃ যোগী ময়ি বর্ততে ॥৩১॥
অর্থ-যে যোগী সর্বভূতে সংস্থাপিত পরমত্মারুপে আমাকে জেনে আমার ভজনা করেন তিনি সর্ব অবস্থাতেই আমাতেই অবস্থান করেন।
আত্ম ঔপম্যেন সর্বত্র সমম্ পশ্যতি যঃ অর্জুন ॥
সুখম্ বা যদি বা দুঃখম্ সঃ যোগী পরমঃ মতঃ ॥৩২॥
অর্থ-হে অর্জুন যিনি সমস্থ জীবের সুখ ও দুঃখকে নিজের সুখ-দুঃখ বলে মনে করেন আমার মতে তিনিই সর্বশ্রেষ্ঠ যোগী।
অর্জুন উবাচ
যঃ অয়ম্ যোগঃ তয়া প্রোক্তঃ সাম্যেন মধুসুদন ॥
এতস্য অহম্ ন পশ্যামি চঞ্চলত্বাত্ স্থিতিম্ স্থিরাম্ ॥৩৩॥
অর্থ-অর্জুন বললেন-হে মধুসুদন তুমি যে যোগ উপদেশ করলে, আমার মনের চঞ্চল স্বভাব বসত আমি তা সত্ত্বেও নিশ্চল স্থিতি দেখতে পাচ্ছি না।
চঞ্চলম হি মনঃ কৃষ্ণ প্রমাথি বলবত্ দৃঢ়ম্ ॥
তস্য অহম্ নিগ্রহম্ মন্যে বায়ো ইব সুদুস্করম ॥৩৪॥
অর্থ-হে কৃষ্ণ মন অত্যন্ত চঞ্চল প্রবল এবং শরির ও ইন্দ্রিয়াদি বিক্ষেপ উত্পাদক তাকে বিষয় বাসনা থেকে নিবৃত্ত করা অত্যন্ত কঠিন তাই এই মনকে নিগ্রহ করা বায়ুকে বশীভুত করার থেকেও কঠিন বলে আমি মনে করি
ভগবান উবাচ
অসংশয়ম্ মহাবাহো মনঃ দুর্নিগ্রহম্ চলম্ ॥
অভ্যাসেন তু কৌন্তেয় বৈরাগ্যেন চ গৃহ্যতে ॥৩৫॥
অর্থ-ভগবান বললেন-হে মহাবাহো মন যে দুর্বার ও চঞ্চল ততে কোন সন্দেহ নাই।কিন্তু হে কৌন্তেয় ক্রমশ অভ্যাস ও বৈরাগ্যের দ্বারা মনকে বশীভুত করা যায়।
অসংযত আত্মনা যোগঃ দুসপ্রাপ্যঃ ইতি মে মতিঃ ॥
বশ্য আত্মনা তু যততা শক্যঃ অবাপ্তুম্ উপায়ত ॥৩৬॥
অর্থ-অসংযত ব্যাক্তির পক্ষে আত্মোউপলব্ধি দুসপ্রাপ্যঃ কিন্তু যার মন সংযত এবং যিনি যথার্থ উপায় অবলম্বন করে মনকে বশ করতে চেষ্টা করেন তিনি অবশ্যই সিদ্ধি লাভ করে।
অর্জন ঊবাচ
অযতিঃ শ্রদ্ধয়া উপেতঃ যোগাত্ চলিত মনসঃ ॥
অপ্রাপ্য যোগ সংসিদ্ধিম্ কাম্ গতিম্ কৃষ্ণ গচ্ছতি ॥৩৭॥
অর্থ-অর্জুন জিজ্ঞাসা করলেন-হে কৃষ্ণ শ্রদ্ধাবান সম্যক যত্নহীন যোগচ্যুত যোগী যোগে সিদ্ধি লাভ না করলে কোন মার্গে গমন করেন।
কচ্চিত্ ন উভয় বিভ্রষ্টঃ ছিন্ন অভ্রম্ ইব নশ্যতি ॥
অপ্রতিষ্ঠঃ মহাবাহো বিমূঢ় ব্রাহ্মনঃ পথি ॥৩৮॥
অথর্- হে মহাবাহো কৃষ্ণ ব্রহ্ম লাভের পথ থেকে বিমূঢ় হয়ে অপ্রতিষ্ঠ হয়ে পড়ে যে ব্যক্তি, সে কি ছিন্ন মেঘের মত একেবারে নষ্ট হয়ে যায়।
এতত্ মে সংশয়ম্ কৃষ্ণ ছেত্তুম্ অর্হসি অশেষতঃ ॥
ত্বত্ অন্যঃ সংসয়স্য তস্য ছেত্তা ন হি উপপদ্যতে ॥৩৯॥
অর্থ-হে কৃষ্ণ তুমিই কেবল আমার এই সংসয় দুর করতে সমর্থ। কারন তুমি ছারা আর কেউ এই সংসয় দুর করতে পারবে না।
ভগবান উবাচ
পার্থ নৈব ইহ ন অমুত্র বিনাশ তস্য বিদ্যতে ॥
ন হি কল্যান কৃত্ কশ্চিত্ দুর্গতিম্ তাত গচ্ছতি ॥৪০॥
অর্থ-ভগবান বললেন-হে পার্থ শূভানুষ্ঠানকারি পরমার্থবিদের ইহলোক এবং পরলোকে কোন দুর্গতি হয় না,হে বৎস্য তার কারন কল্যান কারির কখনো অধঃগতী হয় না।
প্রাপ্য পুন্যকৃতম্ লোকান উষিত্বা শাশ্বতীঃ সমাঃ ॥
শুচিনাম্ শ্রীমতাম্ গেহে যোগভ্রষ্টঃ অভিজায়তে ॥৪১॥
অর্থ-যোগভ্রষ্ট ব্যক্তি পুন্যবানদের প্রাপ্য সর্গাদি লোক সকলে বহুকাল বাস করে সদাচারি গৃহে অথবা ধনীলোকদের গৃহে জন্ম গ্রহন করেন।
অথবা যোগীনাম্ এব কুলে ভবতী ধীমতাম্ ॥
এতত্ হি দুর্লভতরম্ লোকে জন্ম যত্ ঈদৃশম্ ॥৪২॥
অর্থ-অথবা যোগভ্রষ্ট পুরুষ জ্ঞানবান যোগীগনের বংশে জন্মগ্রহন করেন।এই প্রকার জন্ম এই জগতে অবশ্য অত্যন্তই দুর্লভ।
অত্র তম বুদ্ধি সংযোগম লভতে পৌর্বদেহিকম্ ॥
যততে চ ততঃ ভূয় সংসিদ্ধৌ কুরুনন্দন ॥৪৩॥
অর্থ-হে কুরুনন্দন সেই প্রকার জন্মগ্রহন করার ফলে তিনি পুনরায় তার পুর্বজন্মকৃত পারমার্থিক চেতনায় বুদ্ধি সংযোগ লাভকরে সিদ্ধি লাভের জন্য পুনরায় যত্নবান হন।
পুর্ব অভ্যাসেন তেন এব হ্রিয়তে হি অবশঃ অপি সঃ ॥
জিজ্ঞাসুঃ অপি যোগস্য শব্দব্রহ্ম অতিবর্ততে ॥৪৪॥
অর্থ-তিনি পুর্ব জন্মের অভ্যাস বশে যেন অবশ হয়েও যোগ সাধনার প্রতি আকৃষ্ট হন। এই প্রকার যোগশাস্ত্র জিজ্ঞাসু পুরুষ যোগ অনুশিলন করার সময়ই বেদোক্ত সকাম কর্ম মার্গকে অতিক্রম করেন,অর্থাত্ সকাম কর্ম মার্গে যে ফল নিদৃষ্ট আছে, তার থেকে উত্কৃষ্ট লাভ করেন।
প্রযত্নাত্ যতমানঃ তু যোগী সংশুদ্ধ কিল্বিষঃ ॥
অনেক জন্ম সংসিদ্ধঃ ততঃ যাতি পরাম্ গতিম্ ॥৪৫॥
অর্থ-যোগী ইহ জন্মে পুর্বজন্মকৃত যত্ন অপেক্ষা অধিকতর যত্নকরে পাপ মুক্তহয়, পুর্ব জন্মের সাধন সঞ্চিত সংস্কার দ্বারা সিদ্ধি লাভ করে পরম গতী লাভ করেন।
তপস্বিভ্যঃ অধিকঃ যোগী জ্ঞানিভ্যঃ অপি মতঃ অধিকঃ ॥
কর্মিভ্যঃ চ অধিকঃ যোগী তস্মাত্ যোগী ভব অর্জুন ॥৪৬॥
অর্থ-যোগী তপস্বীদের চেয়ে শ্রেষ্ঠ জ্ঞানিদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ এবং সকাম কর্মিদের চেয়েও শ্রেষ্ঠ অতএব হে অর্জুন সর্ব অবস্থাতেই তুমি যোগী হও।
যোগীনাম অপি সর্বেষাম মদ্গতেন অন্তরাত্মনা ॥
শ্রদ্ধাবান ভজতে যঃ মাম সঃ মে যুক্ততমঃ মতঃ ॥৪৭॥
অর্থ-যিনি শ্রদ্ধা সহকারে মদ্গত চিত্তে আমার ভজনা করেন,তিনিই সব চেয়ে অন্তরঙ্গ ভাবে আমার সঙ্গেযুক্ত এবং তিনিই সমস্ত যোগীদের খেকে শ্রেষ্ঠ।
ওং তত্সদিতি শ্রীমদ্ভগবদ্গীতাসূপনিষত্সু ব্রহ্মবিদ্যাযাং যোগশাস্ত্রে শ্রীকৃষ্ণার্জুনসংবাদে
আত্মসংযমযোগো নাম ষষ্ঠোঽধ্যাযঃ ॥৬॥